শ্রী বড়ে দাদাজী

শিবের সমান শ্রী দাদাজী মহারাজও সনাতন ও আদি। শ্রী দাদাজী ধূনীওয়ালোঁর পরম্পরায় ভোলানাথের সদৃশ শ্রী বড়ে দাদাজী মহারাজের উদ্যমেরও কোনো প্রাকট্য নেই

প্রায় ঊনবিংশ শতাব্দীর প্রারম্ভে কাবুলে এক পশতু সন্তের কথা শোনা যায়, শ্রী গৌরী শংকরজী মহারাজ, যিনি শিবের বড় ভক্ত ছিলেন। বড় বিচিত্র ছিলো তাঁর রূপ। বড় বড় কান, বৃহদাকায় মুখমণ্ডল, অতীব লম্বা এবং তেজস্বী। শিবের দর্শন প্রত্যাশায় আকুল শ্রী গৌরী শংকর নানান আশ্রমে সাধু সন্তেদের কাছে গেলেন। ওনার আকুলতা দেখে একদিন এক সাধু বল্লেন, কথিত আছে “নর্মদার কাঁকর, সবি শংকর”, অর্থাৎ নর্মদার কুলেই শিবকে পাওয়া যাবে। একথা শোনা মাত্রই, সুদূর আফগানিস্তান থেকে নর্মদার উদ্দেশ্যে রওনা দেন তিনি, শুরু হয় তাঁর নর্মদা পরিক্রমা।

সাধুদের এক সংঘের সাথে যুক্ত হলেন, প্রভাবশালী ও বেদজ্ঞ হওয়ার কারণে অচিরেই সেই সংঘের মহন্ত পদ পেলেন। পরিক্রমা চলাকালীন অনেক সাধু সন্যাসী যোগ দিলেন সংঘে, ধীরে ধীরে সংখ্যাটা হয়ে দাঁড়ালো ১৫০ এর কাছাকাছি।

সংঘের যাবতীয় জিনিসপত্র ৪০-৫০ টি ঘোড়ায় চাপিয়ে প্রায় ১২ বছরে নর্মদার এক পরিক্রমা সমাপ্ত হতো। এমন তিনটি পরিক্রমা শেষ করেও যখন শিবের দেখা মিলল না, হতাশা ঘিরে ধরলো গৌরী শংকর কে। নর্মদার কোলে প্রাণ ত্যাগ করার সিদ্ধান্ত নিলেন তিনি। সেসময় তাঁর সংঘ সাইখেড়ার কাছে শ্রী শ্রী সংঘু তে ছিল। প্রতিদিন ভোর ৪ ঘটিকায় প্রাতঃস্নান এ যেতেন তিনি। ওই দিন ৩ঃ৩০ বাজতে না বাজতেই নর্মদার তীরে পৌঁছে গেলেন। কিন্তু যেই তিনি নর্মদার জলে পা দিয়েছেন, একটি ৩-৪ বছরের বালিকা পিছন থেকে ওঁর কড়ে আঙুল টেনে ধরল, বললঃ ” কি রে? ডুবতে যাচ্ছিস? মরতে যাচ্ছিস?”! গৌরী শংকর আশ্চর্য চকিত হয়ে গেলেন, ওঁর জল সমাধির অভিপ্রায় এর কথা তো কেউ জানেনা, তাহলে এই বালিকা কিকরে জানল? বালিকা শক্ত করে তাঁর কব্জি ধরে আবার বললোঃ ” আচ্ছা, কথা মানবি না? মরবিই? ডুববিই?”! মহারাজ বালিকা কে জিজ্ঞেস করলেনঃ “তুমি কে?”! জবাব এলঃ “আমি নর্মদা”! মহারাজ বললেনঃ “আমি বিশ্বাস করিনা”, এই বলে হাত ছাড়িয়ে নিয়ে এগিয়ে নেমে গেলেন জলে। বালিকা আবার তাঁর কব্জি ধরে ফেললো। আশ্চর্য! ওই ছোট্ট বালিকার শক্তি এবার যেন এক বলশালী যুবকের সমান! গৌরী শংকর আবার জিজ্ঞেস করলেন ও কে? একই উত্তর পেয়ে বললেন “আমি মানিনা! তুমি যদি নর্মদা হও তবে স্বরূপে প্রকাশ হও”। নর্মদা দিব্য রূপে আবির্ভূত হয়ে বললেনঃ ” তুই যা করতে চলেছিস তা কাপুরুষোচিত! তুই ভুল করছিস! তোর সংঘে কেশব (বড়ে দাদাজী) নামের যুবক, সে ই সাক্ষাৎ শিব!

এ কথা শুনে গৌরী শংকর তৎক্ষণাৎ সংঘ অভিমুখে ফিরে গেলেন।

ফিরতি পথে ওনার মনে পড়লো, পরিক্রমণে বেরনোর আগে কেশব কাকভোরে উঠে একা হাতে সবার জন্যে হালুয়া, মালপোয়া আর পায়েস বানায়। কখনো কখনো ঘি কম পরলে নর্মদার জলেই তৈয়ার হয় সুস্বাদু মালপোয়া, পায়েস। খেয়ে মনে হয় যেনো ঘি দিয়েই তৈরী। কখনো সখনো যখন সংঘে ঘি পর্যাপ্ত হয়ে যায়, কেশব সেই ঘি নর্মদার জলে উৎসর্গ করে দেয়। কেশবের কিছু বিশেষ সিদ্ধি আছে এ কথা জানতেন মহারাজ। কিন্তু কেশব যে সাক্ষাৎ মহাদেব হতে পারে, এ কথা তিনি স্বপ্নেও ভাবেননি।

দ্রুত পা এ হেঁটে সংঘে পৌঁছেই সোজা পাক ঘরে গেলেন মহারাজ, কেশব পিছন ফিরে বাসন ধুচ্ছিল। আস্তে করে ডাকলেন, কেশব ফিরে তাকাল। কিন্তু এ কি দেখলেন! এ যে সাক্ষাৎ ভগবান শিবের রূপ! গৌরী শংকর চোখ কচলে তাকালেন, বার বার, কিন্তু বার বারই সেই একই রূপ দেখতে পেলেন তিনি। তবুও যেন পূর্ণ রূপে বিশ্বাস করতে পারছেন না। তখন আবার মা নর্মদাকে স্মরণ করলেন, উনি ই এসে ভ্রম দূর করুন। যেভাবে মা নিজে পূর্ণ রূপে দশর্ন দিয়েছিলেন সেভাবেই যেন ভোলানাথের দশর্ন করান। নর্মদা প্রার্থনা শুনে প্রকট হলেন, বললেনঃ “বিশ্বাস হয় না তো ছুঁয়ে দেখ”। গৌরী শংকর ধীরে ধীরে কেশবের কাছে গিয়ে চরণ স্পর্শ করলেন। সঙ্গে সঙ্গে কেশবের মধ্যে পদ্মাসনে ধ্যানমগ্ন শিব দর্শন দিলেন, বললেনঃ ” আমার দর্শন পেলে। এবার দল নিয়ে এগিয়ে যাও আর কিছুদিন এ সত্য গোপন রেখো”। এই বলে জঙ্গলের দিকে প্রস্থান করলেন।

শ্রী গৌরী শংকর দল নিয়ে কিছুদূর কোকসর পৌঁছলেন এবং কেশবের (দাদাজী) রহস্য সবাইকে জানালেন। গৌরী শংকর তাঁর সারাজীবনের তপস্যার ফল পেলেন, আর কোনো সাধ বাকি রইল না। উনি সমাধি নিলেন।

কিছু কাল পরে হোশঙ্গাবাদের রামলাল দাদার কাছে এক দিগম্বর সন্যাসী এলেন, এক চমৎকারি সন্যাসী। তিনি ই বড়ে দাদাজী। তিন বছর ছিলেন তিনি। তারপর একদিন কুয়া তে পড়ে যাওয়ায় নিজের প্রাণ ত্যাগ করলেন।

তার কিছুদিন পর সোহাগপুরের ইম্লিয়া জঙ্গলে বৃক্ষ তলে ভস্ম মাখা দাদাজী কে দেখা গেল। গ্রামবাসীর প্রার্থনায় তিনি তাদের সাথে নরসিংহপুর রওনা হলেন। নরসিংহপুর নর্মদা থেকে ১০-১২ কিলোমিটার দূরে। সেখানেও তিনি নানান অলৌকিক লীলা দেখিয়ে ভক্তদের আনন্দ দিলেন। তারপর আবার সমাধি নিলেন।

এরপর উনি আরো একবার রাম ফল দাদা নামে সীসীরি সিন্দুক গ্রামে প্রকাশিত হলেন। প্রায় ১৯০১ সন থেকে বহু বৎসর সেখানে থেকে নিজের অলৌকিক লীলা দেখিয়ে সেখানকার অধিবাসীদের দুঃখ কষ্ট দূর করেছিলেন, তাদের পাপ মোচন করেছিলেন।

সাঁইখেরায় গাঁয়ের বাচ্চারা “পাগলা বাবা” “পাগলা বাবা” বলে দাদাজী কে বড্ড বিরক্ত করতো। দাদাজী বাড়ির ছাদ থেকে মাটির ঢেলা ছুঁড়তেন বাচ্চাদের দিকে। আশ্চর্যের কথা, যার গায়ে সেই ঢেলা লাগতো, সে রোগমুক্ত হয়ে যেতো!

বাচ্চাদের তাড়ানোর জন্য হাতে ডান্ডা নিয়ে রাস্তায় বেরোতেন দাদাজী। তাই লোকেরা ওনাকে ‘ডান্ডাওয়ালে দাদা’ বলেও ডাকতো। দাদাজীর হাতের ডান্ডা যার ওপর পড়তো, সে উদ্ধার হয়ে যেতো।

দাদাজী দিনভর গরু চরাতেন, মাঠে জঙ্গলে ঘুরে বেড়াতেন, আর রাতে এক শুকনো আম গাছের কোটরে আশ্রয় নিতেন। একদিন ওই আম গাছের শুকনো কাঠ পুড়িয়ে সেই ভস্ম মাখলেন সারা অঙ্গে। সেদিন থেকে তিনি ‘ধুনীওয়ালে দাদাজী’ নামে পরিচিত হতে লাগলেন।

প্রায় তিরিশ বৎসর দাদাজী সাঁইখেরা ও তার আশেপাশের অঞ্চলে ভ্রমণ করে কাটান। যেখানে তাঁর মন চাইতো, সেখানেই বিশ্রাম নিয়ে নিতেন। কখনো নর্মদা তীরে, কখনো ক্ষেতে, কখনো গাছের তলায়, আবার কখনো কারো বাড়িতে। ওঁর গালি বা ডান্ডা যার ওপরেই পড়তো, তার কল্যাণ হতো।

দাদাজীর খ্যাতি শুনে একদিন স্বাধীনতা সংগ্রামী মদন মোহন মালব্য ও পন্ডিত জহরলাল নেহরু মহাত্মা গান্ধী কে নিয়ে দাদাজীর দর্শন করতে এলেন। গান্ধীজীর পর জখন পন্ডিত নেহরু প্রণাম করলেন, দাদাজী নিজের চিরাচরিত রৌদ্র রূপ ধারণ করে ডান্ডার বাড়ি মারলেন পন্ডিতজী কে। বললেন “এ ই যোগ্য, এ ই স্বরাজ আনবে দেশে”। এই বলে নিজের ডান্ডা দিয়ে দিলেন পন্ডিতজী কে।
১৯৭৭ সাল। শ্রী ছোট সরকারজী ইন্দিরা গান্ধীর তৎকালীন আবাস, ২৪ আকবর রোড এ. আই. সি. সি হেড কোয়ার্টার এ গেলেন দেখা করতে। শ্রী ইন্দোর সরকারের পাঠানো বেল ফুলের মালা ইন্দিরা গান্ধীর হাতে বাঁধতে বাঁধতে ইন্দোর সরকারজীর বার্তা দিলেন ” আপনি আবার প্রধানমন্ত্রী হবেন”। উনি ইন্দিরা গান্ধীকে মনে করালেন পন্ডিতজীকে বড়ে দাদাজীর ডান্ডা মারার গল্প। ইন্দিরা গান্ধী জানতেন সে কথা। শ্রী ছোটে সরকারজী কে ঠাকুরঘরে নিয়ে গিয়ে দেখালেন সেই ডান্ডা। বললেন, তাঁর বাবা, পন্ডিত জহরলাল নেহরু এই ডান্ডা সর্বদা সঙ্গে রাখতেন।

কয়েকমাস পর ইন্দিরা গান্ধী আবার প্রধানমন্ত্রী হলেন।

বাগলির ভোপাল নবাব হামিদুল্লা খানের স্ত্রী বড়ই অপ্রিয় স্বভাবের মহিলা ছিলেন। হিন্দু সাধু-সন্ত দের সাথে দুর্ব্যবহার করতেন, তাঁদের সিদ্ধি কে পরখ করার ছলে তাঁদের অপমান করতেন। দাদাজীর দল যখন নর্মদা তীরে পৌঁছালো, তিনি দাদাজী কে পরখ করতে একটি পাত্রে মাংসের টুকরো ঢেকে চাকরের হাত দিয়ে পাঠিয়ে দিলেন।
দাদাজী দূর থেকে ওই চাকরটি কে আসতে দেখেই স্ব-মূর্তি ধরলেনঃ “আচ্ছা! বেগম পাঠিয়েছে আমাকে পরখ করতে”! বলে খুব গাল পাড়লেন। দাদাজীর রৌদ্র রূপ দেখে চাকরটি খুব ভয় টয় পেয়ে ফিরতি পথ ধরলো। তাই দেখে দাদাজী আরো রেগে মেগে বললেনঃ “পালাচ্ছিস! থালা দিয়ে যা বলছি”! এই বলে থালায় সজোরে মারলেন ডান্ডা, আর থালার সব সরঞ্জাম মাটিতে পড়ে গেল। আশ্চর্যজনক ভাবে থালার মাংসের টুকরো ফুল হয়ে ছড়িয়ে পরল। হতভম্ব চাকরটি একটি ফুল তুলে নিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বেগমের কাছে পৌঁছে সব কিছু সবিস্তারে জানাল।
বেগম দমবার পাত্র নয়। মনে মনে ভাবল, চাকরটি হিন্দু, ও ই নিশ্চই পাত্রে মাংসের বদলে ফুল রেখে দিয়েছিল। সে আবার আরেকটি পাত্রে মাংসের টুকরো নিয়ে স্বয়ং হাজির হল দাদাজীর সামনে। দাদাজী তো তাকে দেখেই অগ্নিশর্মা। শক্ত করে ওর হাত ধরে বললেনঃ ” আচ্ছা রে বেটি, আমায় পরখ করতে এসেছিস”! বলে এক ঝটকায় থালার ঢাকা সরিয়ে দিলেন। বেগম বিস্ফারিত চোখে দেখলেন থালা ভর্তি খোয়া ক্ষীর! দাদাজী এতেও শান্ত হলেন নাঃ “এখনো তোর সন্দেহ যায়না! তবে খা এই ক্ষীর.. খা.. খা”! বলে জোর করে বেগম কে ক্ষীর খাওয়াতে লাগলেন। বেগম আর খেতে পারেনা। কিন্তু দাদাজী কে থামায় কার সাধ্যি! ডান্ডা দিয়ে মুখের মধ্যে প্রায় ঠুসে দিলেন আরও ক্ষীর। বেগম ভীষণ ভয় পেয়ে হাতজোড় করে ক্ষমা চাইল, বললঃ “আমি বুঝতে পেরেছি! আপনি একজন ঔলিয়া (সিদ্ধ পুরুষ)”! দাদাজী গর্জ্জে উঠলেনঃ “সিদ্ধ পুরুষ নই, আমি সিদ্ধ পুরুষের বাপ”! এই বলে বেগমকে হুকুম দিলেন- সাধু-সন্ত, যাদের বন্দী বানিয়ে রেখেছে তাদের যেন অবিলম্বে মুক্তি দেয়।
পরেরদিন বেগম তার স্বামী হামিদুল্লা খানের সাথে ঘোড়ার গাড়ি চড়ে দাদাজীর কাছে এসে দাদাজী কে তাদের আতিথ্য স্বীকার করতে অনুনয় করলো। দাদাজী রাজী হলেন, চড়ে বসলেন রথে। রথে উঠেই তিনি স্বামী স্ত্রী ও গাড়োয়ান কে ধমকে নামিয়ে দিলেন রথ থেকে। নবাব ও তার বেগম দাদাজী কে ঘোড়া সমেত রথ উপহার দিতে চাইলে দাদাজী বললেনঃ “ঘোড়া নেবোনা, ঘোড়াও তোর অন্ন খেয়েছে”! ঘোড়া খুলে ফেলা হল রথ থেকে। দাদাজী মহানন্দে বলতে থাকলেনঃ ” চল্ রে ব্যাটা, গাড়ী হাঁক”! ভক্তরা ভক্তিভরে দাদাজী কে সেই রথে বসিয়ে বেশ কিছুদিন যাত্রা করে খন্ডওয়া পৌঁছালো। এই রথেই দাদাজী সমাধি নিয়েছিলেন। খন্ডওয়ার দরবারে আজও এই রথ দাঁড়িয়ে আছে।

খন্ডওয়া তে তিন দিন থেকে দাদাজী প্রস্থানোদ্যত হলে পার্ব্বতি বাঈ নামে এক বর্ধিষ্ণু পরিবারের মহিলা প্রার্থণা করলেন তার হাতের ডাল ভাতের ভোগান্ন গ্রহণ করতেই হবে। দাদাজী তিনবার তাকে ফিরিয়ে দিলেন। কিন্তু পার্ব্বতি বাঈ মানবার পাত্রী নয়। সে রথের সামনে শুয়ে পরলো। দাদাজীর কোনো প্রত্যাখ্যান শুনলো না। দাদাজী বললেনঃ “আমি ঘুমাতে চললাম, তুই কি করবি তুই জানিস”।

পার্ব্বতি বাঈ রথের বাইরেই দাদাজীর জন্য নৈবেদ্য সাজাল। অনেক্ষণ প্রতীক্ষার পরেও যখন দাদাজী উঠলেন না, তখন সেই নৈবেদ্য সংঘের পারিষদ দের মধ্যে বন্টন করে দিল সে। এর আগে এমন প্রায়ই হত, দাদাজী ২-৩ দিন টানা ঘুমিয়ে থাকতেন। কিন্তু এবার এক পাগল গোছের লোক থানায় গিয়ে বললো, দাদাজী সমাধি নিয়েছেন আর ওঁর ভক্তরা টেরই পায়নি। পুলিশ জিজ্ঞাসাবাদ করতে এলে ভক্তরা ছোটে দাদাজীর কাছে ছুটলো। ছোটে দাদাজী ভক্তদের আসতে দেখেই তিনবার বললেনঃ ” হ্যাঁ, হ্যাঁ রে ভাই, দাদাজী সমাধি নিয়েছেন”! সবাই মিলে বড়ে দাদাজীর দেহ রথ থেকে বের করে খাটিয়ায় শুইয়ে দিল।

যে জমিতে দাদাজীর রথ দাঁড়িয়ে ছিল, ছোটে দাদাজী সেই জমি কিনে নিয়ে সেখানেই বড়ে দাদাজীর সমাধি তৈরী করলেন। সেখানেই অখণ্ড ভস্ম জ্যোতি প্রজ্জ্বলিত করে দরবার স্থাপন করলেন। আরতি, পুজা, ইত্যাদি ২৪ টি নিয়ম বানিয়েছিলেন ছোটে দাদাজী, যা আজও সকল দাদা দরবারে নিষ্ঠাপূর্বক পালন করা হয়।

 

দাদাজীর লীলা
———————-
দাদাজীর খ্যাতি দেশজুড়ে আগুনের ন্যায় ছড়িয়ে পড়ছিল। কাশীর কয়েকজন সাধুর এটা ঠিক পছন্দ হলনা। ওঁরা দাদাজীকে পরখ করবেন বলে ঠিক করলেন। দাদাজী অন্তর্যামী! সব বুঝতে পারলেন। কাশীর সাধুর দল সাইঁখেড়ায় দাদাজীর ডেরায় পৌঁছানোর আগেই তিনি সবাইকে ডেকে বললেনঃ “আজ আমার পরীক্ষা হবে, সবাই তৈরী থেকো”! যেই না সাধুরা পৌঁছলেন, দাদাজী অমনি জোরে জোরে বেদ মন্ত্র বলতে লাগলেন। সে এমন পাঠ, যা অতি ঞ্জানীরও আয়ত্তের বাইরে। কাশীর সাধুরা নিজেদের ভুল বুঝতে পেরে অত্যন্ত লজ্জিত হলেন। ভক্তিভরে দাদাজীর চরণ স্পর্শ করলেন।

এরকম আরো তিন ব্যাক্তি, এক ডাক্তার, এক উকিল আর এক অধ্যাপক, দাদাজীর বাস্তবিকতা নিয়ে যাদের সন্দেহ ছিলো, তারা করলেন কি, দাদাজীর জন্য ফুল মালা মিষ্টির সাথে বিষ নিয়ে হাজির হলেন দাদাজীর কাছে। তাদের মতে, দাদাজী যদি সাক্ষাৎ শিব হন, তবে বিষ তার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। তাদের দেখামাত্র দাদাজী আপ্লুত হয়ে বললেন ” ফল মিষ্টি এনেছিস আমার জন্য! দে দে… দে আমাকে”। বলে ঝোলার ভেতর লুকিয়ে রাখা বিষপাত্র বের করে সবটা পান করে ফেললেন! ওই তিন ব্যাক্তি হতবাক হয়ে দেখলেন সত্যি দাদাজীর কিছুই হলনা। ওরা দাদাজীর কাছে ক্ষমা চেয়ে প্রস্থান করলেন।

দাদাজী শিবমন্দির এর কাছে এক বেল গাছের নীচে ছাই মেখে বসে থাকতেন। জীজাবাঈ নামের এক শিব ভক্ত রোজ সেই শিবমন্দিরে আসতো পুজা করতে। একদিন সকালে শিবমন্দিরের দ্বার খুলেই সে দেখল শিবের স্থানে দাদাজী বসে আছেন! যার পর নাই অবাক হয়ে সে ফিরে তাকাল বেলগাছের নীচে, যেখানে দাদাজী বসে থাকেন। বিস্ফারিত চোখে সে দেখল বেলগাছের নীচে যিনি বসে তিনি স্বয়ং শিব! দাদাজী এভাবেই ভক্তদের শিবরূপে দর্শন দিতেন।

দাদাজীর কাছে নিজের মর্জি তে আসা যেতো, কিন্তু নিজের মর্জিতে ফেরা যেতো না। শালিগ্রাম পটেল নামক দাদাজীর এক ভক্ত দাদাজীর দর্শন করতে এল। প্রায় কুড়ি দিন হতে চলল, কিন্তু ফেরার অনুমতি মিলল না। একদিন রাতে, সংঘের সাধুদের নিয়ে ভস্ম মেখে বসেছিলেন দাদাজী। হঠাৎ কি মনে হল, শালিগ্রাম কে নর্মদা থেকে জল এনে ভস্ম সিঞ্চিত করতে বললেন। শালিগ্রাম দাদাজীর আঞ্জা পালন করল। কিন্তু দাদাজী গেলেন রেগে। চিরাচরিত ভাবে বকাঝকা করে গালি দিয়ে বললেনঃ “কবে থেকে পড়ে আছিস এখানে, যাঃ বাড়ী যা”! শালিগ্রাম কিছুই বুঝল না। এত রাতে গাড়ী নেই ঘোড়া নেই, বাড়ী যাবে কি করে? কিন্তু দাদাজীর হুকুম পালন করতেই হবে। অগত্যা নিজের জিনিসপত্র নিয়ে বাড়ীর উদ্দেশ্য রওনা দিল। বহু কষ্টে নিজের গ্রাম এ ফিরেই সে হতবাক হয়ে গেল। গোটা গ্রামটাই আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেছে, শুধুমাত্র ওর বাড়ীটা অক্ষত রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানতে পারলো, যে সময় গ্রাম আগুনে পুড়ছিলো সে সময় দাদাজী তাকে দিয়ে নিজের ভস্ম জলে ভেজাচ্ছিলেন।

এমন অলৌকিক কথা শুনে সাইঁখেড়ায় বহু সাধু সন্যাসী দাদাজীর দর্শন করতে আসতেন।

বাচ্চাদের প্রতি অমোঘ প্রেম ছিল দাদাজীর। একবার একটি বালক রাস্তার আলোয় বসে লেখাপড়া করছিল। হাবিলদার সেই দোষে তাকে জেল এ ভরে দিল। এই কথা শুনে দাদাজী রুদ্র রূপ ধরলেন। নিজের ডান্ডা দিয়ে রাস্তার সমস্ত বাতি ভেঙে চুরমার করে দিলেন। হাবিলদার দাদাজীকেও বালকের সাথে বন্দী করে দিল। দাদাজী কে বন্দী করে হাবিলদার যেই না বাইরে এসেছে, দেখে দাদাজী নিজের ডান্ডায় ভর দিয়ে দাঁড়িয়ে আছেন রাস্তায়, মিটিমিটি হাসছেন। হতচকিত হাবিলদার দৌড়ে ভেতরে গিয়ে দেখে দাদাজী বালকের সাথে জেলের ভেতর বসে মিটিমিটি হাসছেন। আবার দৌড়ে বাইরে এসে দেখে দাদাজী বাইরে। নাক কান মলে ক্ষমা চেয়ে হাবিলদার বালককে মুক্তি দিল।

এক গরীব মা মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিল না। দাদাজীর স্মরণে এসে নিজের দুঃখের কথা দাদাজী কে সবিস্তারে জানাল সে। দাদাজী বললেন পরেরদিন সকালে তার ঘরে যাবেন তিনি। পরেরদিন সকালে দাদাজী সেই মহিলার বাড়ী হাজির হলেন, মহিলা প্রণাম করতেই দাদাজী বললেনঃ “সর.. সরে যা.. আমি পায়খানা করব”। বলে সোজা রান্নাঘরে গিয়ে উনুনে বসে মলত্যাগ করলেন। যাওয়ার সময় বলে গেলেন ছাই দিয়ে মল ঢেকে দিতে।
মহিলার স্বামী বাড়ী ফিরে এ কথা শুনে খুব রেগে গেলেনঃ ” কেমন গুরু তোমার! মলত্যাগ করার আর জায়গা পেলনা! যাও, ওটা ফেলে উনুন পরিস্কার কর”। মহিলা মল পরিস্কার করতে গিয়ে দেখে মল সোনা হয়ে গেছে। স্বামী স্ত্রী মিলে সেই সোনা ধুয়ে মুছে পাত্রে সাজিয়ে নিয়ে হাজির হলেন দাদাজীর সম্মুখে। দাদাজী ওদের দেখেই রেগে মেগে বললেনঃ “বুঝলিনা, তোর মেয়ের বিয়ের জন্য করেছি এ কাজ। আমায় কেনো দেখাতে নিয়ে এসছিস? যাঃ… মেয়ের বিয়ে দে গিয়ে”! তারা ফিরে গেল। এক টুকরো সোনা বেচে মেয়ের বিয়ে দিল, বাকি সোনার গয়না বানিয়ে দিল মেয়েকে। সেই মেয়ের বংশধরদের কাছে আজও ওই সোনার গহনা যত্ন করে রাখা আছে।

এমন কতবার কতভাবে দাদাজী ভক্তদের কষ্ট দূর করেছেন, তাদের মঙ্গল করেছেন। দাদাজী এমন একজন মহান সন্ত ছিলেন যাঁর জন কল্যাণের জন্য বেদ শাস্ত্র বা মন্ত্রের প্রয়োজন হয়নি। মানুষের কল্যাণ করার ওনার যে উপায় ছিল, তা বড় স্বতন্ত্র, বড় অদ্ভুত! গালি দিয়ে ডান্ডা মেরে লোকের কষ্ট দূর করতেন দাদাজী। দাদাজীর ডান্ডার বাড়ি খাবার জন্য ভক্তরা ভীড় করে আসত। কিন্তু সে সৌভাগ্য মাত্র কয়েকজনের কপালেই জুটতো। এমনই ছিলেন আমাদের প্রিয় শ্রী দাদাজী ধুনীওয়ালে। জয় শ্রী দাদাজীর জয়!