ইন্দোর দরবারে গুরু মহারাজ (রামদাসজী) শ্রী ইন্দোর সরকারজীকে (শ্রী রামদয়ালজী) ছিলিম সাজিয়ে দিয়ে সেবা করতেন। ওনার পা কমজোর হবার দরুন লোকেরা ওনাকে কোলে করে গুরু মহারাজের কাছে নিয়ে যেতেন। উনি কিছু দুরেই নেমে গিয়ে তারপর মাটিতে ঘষটে ঘষটে শ্রী ইন্দোর সরকারজীর নিকটে যেতেন ও মাথা নুইয়ে তাঁকে ছিলিম পান করাতেন। আদরের সঙ্গে উনি কখনও নিজের গুরুর মুখদর্শন করেননি।
একদিন ছিলিম পান করতে করতে ইন্দোর সরকারজী গুরু মহারাজ কে বললেনঃ “কেন রগড়াচ্ছিস? দিল্লি যা, দিল্লি দরবার চলে যা”। গুরু মহারাজজী এক ভক্তকে ওনাকে দিল্লির ট্রেনে বসিয়ে দিতে বললেন। ইন্দোর থেকে ছোট লাইনে রতলাম গেলেন। সেখানে এক কুলিকে দিল্লির বড় লাইনের ট্রেনে বসিয়ে দিতে বললেন। উনি প্রতিবন্ধী ছিলেন তাই কেউ ওনার কাছে টিকিট চাইলনা। ওনার কাছে পয়সাও ছিলনা।
রেলগাড়ি দিল্লি পৌঁছাল, ট্রেন খালি হয়ে গেল। একজন কুলি ওনাকে বললঃ ” বাবা, দিল্লি এসে গেছে। এখান থেকে রেলগাড়ী ইয়ার্ড এ যাবে। আপনাকে এখানে নামিয়ে দি?”। কুলি ওনাকে প্ল্যাটফর্মে নামিয়ে দিল আর গুরু মহারাজ ওখানে বসে বসেই দাদানাম জপতে শুরু করে দিলেন। কিছুক্ষন পর কুলি যখন দেখল গুরু মহারাজ ওখানেই বসে আছেন, তখন ওনার কাছে গিয়ে সে বললঃ “বাবা তুমি এখানেই বসে আছ! তুমি যাবে কোথায়? “। গুরু মহারাজজী বললেন উনি দিল্লি যাবেন। কুলি বলল এটাই তো দিল্লি, আর কোন দিল্লি আছে? চল, আমি তোমাকে বাইরে নিয়ে যাই। রিক্সায় বসিয়ে দি। এই বলে সে গুরু মহারাজজী কে উঠিয়ে পুরনো দিল্লি স্টেশনের বাইরে বসিয়ে দিল ও আবার জিজ্ঞেস করলঃ “বল, কোথায় যাবে তুমি?” গুরু মহারাজজী বললেনঃ “আমি তো জানিনা, আমার গুরু আমায় বললেন দিল্লি চলে যা, তাই আমি এখানে চলে এলাম”। কুলি বিরক্ত হয়ে বললঃ ” আরে দিল্লিতে কোথায় যাবে তা তো বল, রিক্সা ভাড়া করি”। গুরু মহারাজজী বললেনঃ “আমি তো জানিনা “। কুলি আপনমনে বক বক করতে করতে গুরু মহারাজজী কে ওখানেই রেখে চলে গেল।
ওখানে ববন নামের এক ব্যাক্তি ঠেলাগাড়িতে মিষ্টি আখ বেচত। সে যখন দেখল দুপুর থেকে সন্ধ্যা হয়ে গেল আর এই বাবা কোথাও গেলনা, তখন সে জিজ্ঞেস করলঃ ” বাবা, কোথায় যাবে তুমি?”। গুরু মহারাজজী সেই একই কথা বললেন আমি জানিনা, আমার গুরু দিল্লি আসতে বলেছেন আমি চলে এসছি। ববন একা প্রতিবন্ধী বাবাকে দেখে দয়া পরবশ হয়ে কিছু আখ খাইয়ে দিল আর নিজের কাজে লেগে গেল। রাতে ঘরে ফেরার সময় সে আবার জিজ্ঞেস করলঃ “বাবা, আপনাকে কি কেউ নিতে আসবে?”। গুরু মহারাজজী বললেন আমি জানিনা। ববন বললঃ ” আপনি আমার ঠেলায় বসুন, আমি আপনাকে নিয়ে যাচ্ছি”। রাস্তায় যেতে যেতে আবার সে জিজ্ঞেস করলঃ “আপনাকে কোথায় নিয়ে যাব?”। সেই একই উত্তর শুনে সে ভাবল, বেচারা একা রাতে কোথায় বা যাবে, তাই সে নিজের ঘরেই নিয়ে এল তাঁকে।
ঘরে এসে বৌয়ের রান্না করা খাবার নিজেও খেল গুরু মহারাজকেও খাওয়াল। শ্রী গুরু মহারাজজী দাদানাম ভজতে ভজতে শুয়ে পড়লেন। প্রাতেঃ ববন নিজে স্নান করার পূর্বে গুরু মহারাজজীকে স্নান করাল। একজন অপরিচিত ব্যাক্তিকে একলা ঘরে রাখা যায়না তাই সে বললঃ ” বাবা, আমি আখ বেচতে যাচ্ছি, আপনাকে কোথায় পৌঁছে দেব?”। গুরু মহারাজজী একই উত্তরের পুনরাবৃত্তি করলেন আমি জানিনা। কি আর করা। সে গুরু মহারাজজী কে ঠেলায় বসিয়ে সঙ্গে নিয়ে গেল।
গুরু মহারাজজী ওর সাথে আখ বেচতে লেগে গেল। কখনো গুরু মহারাজজী আখ ছোলেন, ববন বেচে। আবার কখনো ববন ছোলে, গুরু মহারাজজী বেচেন। ববন জোরে চেঁচিয়ে বলেঃ “মিষ্টি ঠান্ডা আখ নিয়ে যাও” তো গুরু মহারাজজীও তার পুনরাবৃত্তি করেন। ওই দিন ও আখ বেচে দুগুণ লাভ করল। এমনি ভাবে দু তিন দিন কেটে গেল। এর মধ্যে ববন বুঝতে পারল গুরু মহারাজজী একজন সন্ত মহাপুরুষ। সে তাঁকে নিজের বাড়িতে রেখে একলাই আখ বেচতে লাগল।
প্রতি রাতে শয়নে যাবার পূর্বে শ্রী গুরু মহারাজজী দাদাজীর ভজন গাইতেন আর যতদুর তাঁর গলা পৌঁছাত, লোকজন ভজন শোনার টানে ভীড় করে আসত। ভজন শোনার লোকের সংখ্যা বাড়তে লাগল এবং তারা গুরু মহারাজজীকে গুরু মানতে লাগল। ভক্তদের মনকামনা পূর্ণ হতে লাগল আর গুরু মহারাজজীর প্রতি তাদের বিশ্বাস আরো দৃঢ় হতে থাকল।
এক অমাবস্যায় গুরু মহারাজজী ববনের কাছে ইচ্ছা প্রকাশ করলেন যে তিনি যমুনায় স্নান করতে চান। ববন ওনাকে নিজের সাইকেলের পিছনে বসিয়ে নিয়ে গেল। স্নান করে ফেরার পথে মাঝখানে এক জায়গায় তিনি সাইকেল থেকে নেমে বসে পড়লেন, ববন কে বললেন চলে যেতে। ববন বললঃ “না, আপনিও চলুন”। গুরু মহারাজজী বললেনঃ “যাও”। ববন আবার বললঃ ” না, আপনি চলুন”। গুরু মহারাজজী বললেনঃ “আমার স্থান তো এসে গেছে। তুমি এবার যাও। মাঝেমধ্যে ঘুরে যেও”। তারপর তিনি ওখানে বসেই ভজন করতে শুরু করলেন। আজ সেখানেই দিল্লি দরবার স্থাপিত।
সেই সময় ওই জায়গা এবরো খেবরো ছিল। ওখানে রিং রোড তৈরীর কাজ সবে শুরু হয়েছিল আর বহু বাড়ী ও দোকান ভাঙ্গা চোরা অবস্থায় ছিল। গুরুজীর ভক্তদের মধ্যে কয়েকজন পুলিশের লোক ছিল যারা বরখাস্ত হয়েছিল। তারা যখন গুরুজীর কাছে আসত, গুরুজী তাদের দিয়ে রিং রোডের গর্ত ভরাট করাতেন। সময়ের পূর্বেই তাদের সাস্পেনশন মকুব হয়ে গেল। এই খবর পুলিশ দপ্তরে আগুনের মতো ছড়িয়ে পরল যে এক চমৎকারি বাবা আছেন যাঁর কৃপায় সব সমস্যার সমাধান হয়ে যায়। তাই ভক্তদের মধ্যে পুলিশের সংখ্যা হু হু করে বাড়তে লাগল। এই ভক্তদের মধ্যে ভারতের পূর্ব রাষ্ট্রপতি ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদের ড্রাইভার ও ছিল। একদিন সে গুরু মহারাজ কে বলল তার মালিক হাঁপানিতে খুবই কষ্ট পান। গুরু মহারাজজী তার হাতে কিছু ফুল পাতা দিয়ে মালিককে খাইয়ে দিতে বললেন। রাজেন্দ্রপ্রসাদের বোন ভাইয়ের সাথে রাষ্ট্রপতি ভবনেই থাকতেন। ড্রাইভার তাঁকে গুরু মহারাজজীর কথা বললেন ও তাঁর হাতে সেই ফুল পাতা প্রসাদ দিল। সেই প্রসাদ খেয়ে ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদ বড়ই আরাম পেলেন। আরো দু এক দিন ড্রাইভার গুরুজীর প্রসাদ এনে খাওয়াল ওনাকে। তারপর একদিন ওনার বোন স্বয়ং গুরুজীর দর্শন করতে এলেন ও তাঁকে রাষ্ট্রপতি ভবন যাওয়ার জন্য অনুরোধ করলেন, কারণ তাঁর ভাই সরকারি নিয়মে বাঁধা, দর্শনের জন্য স্বয়ং আসতে পারবেন না। ওনার অনুরোধের সম্মান রেখে গুরু মহারাজ নিজেই রাষ্ট্রপতি ভবন গেলেন। এরপর থেকে রাষ্ট্রপতি ভবনে ওনার আসা যাওয়া লেগেই থাকত। কখনো কখনো উনি অনুরোধের খাতিরে সেখানে থেকেও যেতেন। যখন তিনি থাকতেন, লোকজন দেখা করতে আসত, কেউ কেউ তাঁর সাথে ছিলিম সেবন করত। এই ব্যাপারটা নিয়ে রাষ্ট্রপতি ভবনে কয়েকজন আপত্তি তুলল। ডক্টর রাজেন্দ্রপ্রসাদের বোন গুরু মহারাজজী কে বললেন ওনার ছিলিম পান করা নিয়ে কিছু বলার নেই কিন্তু ওনার দেখাদেখি বাইরের লোকেরাও পান করে সেটা ভবনের নিয়মবিরুদ্ধ। গুরু মহারাজজী বললেনঃ “ভাই আমি তো কাউকেই নিষেধ করতে পারব না”। তখন থেকে গুরু মহারাজজী দর্শন দিতে যেতেন কিন্তু থাকতেন না। গুরু মহারাজজীর জীবনকালে ভক্তদের সংখ্যা বাড়তেই লাগল আর এভাবেই ইন্দোর সরকারজীর কথনঃ ” তুই দিল্লি চলে যা। দিল্লি দরবার চলে যা” সত্য হল। আজকের দিনে লক্ষ লক্ষ মানুষ দিল্লি দরবারে দর্শনের জন্য আসে। ওখানেই গুরু মহারাজজীর সমাধি স্থাপিত।
১৯৬৫ সনে একটি বালক ইন্দোর দরবারে শ্রী ইন্দোর সরকারজীর সাথে খেলা করত। শ্রী ইন্দোর সরকারজী সেই বালককে এতোই ভালবাসতেন যে তাকে দত্তক নিয়ে তার নামকরণ করেছিলেন ছোটে সরকার। তাকে যাবতীয় ঔপচারিক ও ধার্মিক শিক্ষা দিয়েছিলেন।
১৯৬৬ সনে শ্রী ইন্দোর সরকারজী ছোটে সরকারজী কে দিল্লি নিয়ে আসেন ও গুরু মহারাজজীর ভক্তদের বলেন গুরু মহারাজজী আবার জন্ম নিয়েছেন এবং স্বয়ং ছোটে সরকারজীই গুরু মহারাজজী। গুরু মহারাজজী শিষ্যদের বলতেন পরের জন্মে উনি এতো বেগে দৌড়বেন যে কেউ ওনাকে ধরতে পারবে না। উনি এও বলতেন যে পরের জন্মে উনি এক বালকের রূপে অনেক চমৎকার করবেন। শ্রী ছোটে সরকারজী বাল্যকালে অনেক চমৎকার দেখিয়েছিলেন। শুধু তাই নয়, উনি ভক্তদের কানে কানে এমন কিছু কথা বলেছিলেন যা সেই ভক্ত ও গুরু মহারাজজী ছাড়া কারো জানার কথা নয়। একদিন উনি গুরু মহারাজজীর সমাধির ওপর দাঁড়িয়ে বললেনঃ “যে অন্দরে সে ই বাইরে”। এইসব ঘটনার পর সকলের বিশ্বাস দৃঢ় হল যে ছোটে সরকারজী ই গুরু মহারাজ। ভক্তরা নিষ্ঠাভরে তাঁর সেবা করতে লাগল।
শ্রী ছোটে সরকারজী পূজা পাঠ যজ্ঞ ও অন্যান্য বৈদিক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভক্তদের ধর্মের পথে চালিত করেন। দাদাজীর স্তুতি করা ও করানোই এনার জীবনের একমাত্র লক্ষ্য।