শ্রী ইন্দোর সরকার

শ্রী রামদয়ালজী মহারাজ রাজস্থানের এক শাহী পরিবারে জন্ম নেন। ওনার সৎ মা ঈর্ষা পরবশ হয়ে নিজের ছেলেকে রাজ গদিতে বসাতে চান। একদিন তিনি রামদয়াল কে শুনিয়ে শুনিয়ে বললেনঃ “গুরু বিনা জীবন বৃথা, গুরু পাওয়া আবশ্যক”। একথা শুনে রামদয়াল গুরুর খোঁজে ঘর ছাড়লেন। পথে অনেক সাধু মহাত্মার সংস্পর্শে এলেন কিন্তু কারো মধ্যেই নিজের গুরুকে খুঁজে পেলেন না। এভাবেই একদিন বদ্রীনাথ মন্দিরে পৌঁছলেন, এবং আকাশবাণী শুনতে পেলেনঃ ” তোর গুরু এখানে থাকলে তো পাবি, আমি তো নর্মদাখন্ডে”। উনি রাজস্থানের মানুষ, নর্মদাখন্ড কোথায় জানতেননা। এক সাধু ওনাকে বললেন নর্মদাতটকেই নর্মদাখন্ড বলে, সে তো অনেক দূর। রামদয়ালজী তৎক্ষনাৎ বেরিয়ে পড়লেন, পায়ে হেঁটেই পৌঁছে গেলেন জব্বলপুরে নর্মদাতীরে।

নর্মদার শীতল জলে স্নান করে পূজা সেরে ছিলিম সেবনকারী এক সাধুর কাছে গিয়ে বললেন আকাশবাণীর কথা। সাধু জানালেন নর্মদার উত্তরী ও দক্ষিণী, দুই তটকেই নর্মদাখন্ড বলে। উনি রামদয়ালজী কে স্কন্দ পুরাণ পড়তে বললেন, যার রেবা খন্ডে এর উল্লেখ আছে। রামদয়ালজী পূর্ব্বেই এর কথা সবিস্তারে পড়েছেন, তিনি সে কথা সাধু মহারাজ কে জানালেন। সাধু বললেন- তাহলে এক কাজ করো, নর্মদার পরিক্রমা শুরু করো। সাধুর কথা মেনে শ্রী রামদয়ালজী পরিক্রমা শুরু করলেন। ঘুরতে ঘুরতে তিনি অমরকন্টক হয়ে সাঁইখেড়ায় পৌঁছলেন।

সাঁইখেড়ায় পৌঁছে দূর থেকেই উনি দাদাজী মহারাজকে গালি দিতে ও ডান্ডা মারতে দেখলেন। দর্শনমাত্রই তাঁর দিব্য অনুভূতি হল যে, তাঁর গুরুর খোঁজ এখানেই পূর্ণ হল। এরমধ্যে প্রসাদ বিতরণ শুরু হল। প্রসাদ নিতে হাত বাড়ালেন, কিন্তু কেউ ওনাকে প্রসাদ দিলোনা। সবাই প্রসাদ খেয়ে কলাপাতা ফেলে দিলে উনি একটি পাতা তুলে তাতে হাত বুলিয়ে নিজের পেটে রাখলেন।। দাদাজীর নজর পড়লো। উনি ডেকে বললেনঃ “আমি প্রসাদি ভক্ত ছিলাম, তুই প্রসাদি ভক্ত কোত্থেকে এলি”। একথা দুবার বলে বললেনঃ “আচ্ছা, রাজস্থানী। আচ্ছা মেজর। আচ্ছা রাজকুমার”। শ্রী রামদয়ালজী হাতজোড় করে দাদাজীর সম্মুখে দাঁড়িয়ে রইলেন। দাদাজী বললেনঃ ” বেশ, এবার ওই ফৌজ ছাড়ো, আমার ফৌজে সামিল হও”। এরপর শ্রী রামদয়ালজী দাদাজীর সেবায় লেগে পড়লেন।

দাদাজী একদিন ওনাকে ডেকে বললেনঃ “আমার ছোটোর সেবায় থাকো”। গুরু আজ্ঞা পেয়ে রামদয়ালজী ছোটে দাদাজীর নিরন্তর সেবায় নিজেকে নিযুক্ত করলেন। উনিই ওনার ধুনির কাঠ সাজাতেন, যজ্ঞের কাঠ জোগাড় করতেন, স্নান করাতেন এবং আরও অন্যান্য সেবা করতেন। সেবায় প্রসন্ন হয়ে ছোটে দাদাজী ওনাকে ইন্দোর সরকার খেতাব দিলেন। ছোটে দাদাজী ও বড়ে দাদাজীর সাথে উনিও সাঁইখেড়া ছাড়লেন, আর ১৯৩০ এ ছীপানের, বাগলী, উজ্জয়িনী, ইন্দোর, নাওঘাট খেড়ী (বরওয়াহ), দাউদবাদ ও খন্ডওয়া যাত্রা করেছিলেন।

১৯৪২ সালে কুম্ভমেলায় ছোটে দাদাজী সমাধি নেন। ছোটে দাদাজী মহারাজ সমাধিস্থ হবার পর বেশ কিছু ভক্ত মনে করলো যে, আর কি! ছোটে দাদাজী মহারাজ সমাধি নিয়ে নিলেন। এই ভেবে জিনিসপত্র গুছিয়ে ওখান থেকে রওনা দিলেন। শ্রী ইন্দোর সরকারজী এবং অন্যান্য কয়েকজন শিষ্য শ্রী ছোটে দাদাজী মহারাজের দিব্য শরীর খন্ডওয়ায় নিয়ে যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন, তখনই কুম্ভে আসা বড় বড় সাধু সন্যাসীরা তাদের রাস্তা অবরোধ করেন, বলেন- প্রয়াগের মতো পবিত্র স্থানে ছোটে দাদাজী মহারাজ প্রাণ ত্যাগ করেছেন, সুতরাং এখানেই ওনার জলসমাধি হওয়া উচিত। শ্রী ইন্দোর সরকারজী ছোটে দাদাজীর ভক্ত বিশ্বনাথ চৌধুরী কে ডেকে পাঠালেন যার বাংলোতে ছোটে দাদাজীর থাকার বন্দোবস্ত হয়েছিল। সবার সামনে তিনি তাকে স্মরন করতে বললেন যে কিছুদিন আগেই ছোটে দাদাজী মহারাজ খন্ডওয়া যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে বলেছিলেন। তার মানে ছোটে দাদাজীর খন্ডওয়া যাবার ইচ্ছে ছিল। বিশ্বনাথ চৌধুরী তৎক্ষনাৎ দাদাজীর দিব্য শরীর নিয়ে যাওয়ার জন্য বাক্সর ব্যবস্থা করলেন ও কাশী এক্সপ্রেস ট্রেন এ অতিরিক্ত কামরা লাগালেন। দাদাজীর ভক্তরা যখন দেখল অতিরিক্ত কামরাটি একটি মালগাড়ীর ডিব্বা, তারা খুবই দুঃখ পেল যে ছোটে দাদাজীর মতো মহান সদগুরু কে মালগাড়ীর ডিব্বায় নিয়ে যাওয়ার প্রবন্ধ করা হয়েছে। বিশ্বনাথ চৌধুরী ক্ষমা চাইলেন যে তাড়াতাড়িতে ভুল হয়ে গেছে। শ্রী ইন্দোর সরকারজী বললেনঃ “ভুল তোর হয়েছে, এবার তুই বোঝ”। এই বলে তিনি রাজানন্দজী, স্বামী চরণানন্দজী, বীরেন্দর বাহাদুর সিং, পাহাড়ী বাবা এবং বাকি ভক্তদের সাথে দাদা নাম ভজনা করতে করতে ওই ডিব্বাতেই শ্রী ছোটে দাদাজী কে খন্ডওয়া নিয়ে এলেন।

খন্ডওওয়ায় ভক্তরা শ্রী ছোটে দাদাজীর সমধি শ্রী বড়ে দাদাজীর সমক্ষে বানাল। যে সকল ব্যঞ্জনাদি উনি পছন্দ করতেন, যথা, মালপোয়া, ক্ষীর, দাল বাটি, জোয়ারের রুটি ইত্যাদি দিয়ে নৈবেদ্য সাজানো হল। নতুন বস্ত্র রাখা হল। সন্ত সমাধিতে নুনের ব্যবহারের রীতি নেই তাই খন্ডওয়ায় মজুত সব কর্পূর কেনা হল। তাও পর্যাপ্ত না হওয়ায় ইন্দোর থেকেও কর্পূর আনানো হল। সব মিলিয়ে ১২কিলো কর্পূর লেগেছিল শ্রী ছোটে দাদাজীর সমাধিতে।

ইন্দোর সরকারজী কয়েকবছর ওখানেই থেকে দুই সমাধির সেবা, পূজা পাঠ ও নিয়ম পালন করলেন। ইতিমধ্যেই দাদাজীর উত্তরাধিকার হওয়া নিয়ে শিষ্যদের মধ্যে মতবিরোধ শুরু হয়ে গেল, আর ওখানকার পরিবেশ নষ্ট হতে থাকল, যার জন্য ইন্দোর সরকার অত্যন্ত মনকষ্টে ভুগতে লাগলেন। স্বামী চরণানন্দজী নিজেকে দাদাজী মহারাজের উত্তরাধিকার ঘোষণা করতে চাইলেন কিন্তু তাতে বাকিদের আপত্তি ছিল। এই বাদ বিবাদে বিরক্ত হয়ে ইন্দোর সরকারজী ১৯৪৮ সনে রেললাইন ধরে পায়ে হেঁটেই ইন্দোর ফিরে গেলেন।

১৯১২ সনে শ্রী বড়ে দাদাজী মহারাজ ও শ্রী ছোটে দাদাজী মহারাজ ইন্দোর এসেছিলেন। ওখানকার ছত্রীবাগ এলাকায় শ্রী বড়ে দাদাজী মহারাজ নিজের রথ রেখেছিলেন যেখানে আজ শ্রী ভেংকটেশ মন্দির রয়েছে, এবং শ্রী ছোটে দাদাজী কিছু দুরেই ধুনী জ্বালিয়েছিলেন। ওই স্থানেই শ্রী ইন্দোর সরকারজী পুনঃ ধুনী প্রজ্জ্বলিত করলেন আর কেবল জল খেয়ে ১২ বৎসর কঠোর তপস্যা করলেন। ভক্তরা যা কিছু ওনাকে নিবেদন করত, যথা কাপড়চোপড়, ফল ইত্যাদি, উনি সেসব হয় ধুনীতে সমর্পন করতেন নয় লোকেদের বিলিয়ে দিতেন। ওই দিব্য স্থানেই আজ শ্রী দাদা দরবার ইন্দোর স্থাপিত। প্রতি গুরুপূর্ণিমা, দশহরা ও অন্যান্য উৎসবে তিনি খন্ডওয়া আসতেন। ইন্দোর রাজ্যের মহারাজ তুকোজীরাও হোলকর, জয়পুরের মহারাজ জয় সিংহ, সোহাওয়াল রাজ্যের বীরেন্দ্র বাহাদুর সিং ও আরো বহু রাজা রাজরারা ওনাকে নিজেদের আধ্যাত্মিক গুরু মানতো।

খন্ডওয়ায় সমাধির সেবা ও অন্যান্য কাজের সুত্রে তাঁর আসা যাওয়া লেগেই থাকতো। সংযোগ বশতঃ একদিন স্টেশনে ওনার সাথে মধ্যপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী শ্রী ভগবন্তরাও মন্ডলোইর সাক্ষাৎ হল, ওনাকে খন্ডওয়া দরবারের অন্তর্কলহের বিষয়ে অবগত করালেন। মুখ্যমন্ত্রী ইন্দোর সরকারজীর কাছে ওনার ইচ্ছা জানতে চাইলেন আর ১৯৬২ সনে দরবারের ট্রাস্ট গঠন করলেন। শ্রী ইন্দোর সরকারজী স্বামী চরণানন্দজীকে ট্রাস্ট এ সামিল করার ইচ্ছা প্রকাশ করলেন, কিন্তু বাকি ট্রাস্টিদের এ কথা পছন্দ হলনা, আর তখন থেকেই উনি ইন্দোর সরকারজীর সঙ্গে শত্রুতা করতে শুরু করেন।

১৯৮৯ সনের ২৮শে ফেব্রুয়ারী, ১০৫ বছর বয়সে ইন্দোর সরকারজী দেহত্যাগ করেন। ইন্দোর দরবারে ওনার উত্তরাধিকারী শ্রী ছোটে সরকারজী মহারাজ ওনাকে সমাধিস্থ করেন।